জামিয়ার অতীত ও বর্তমান

জামিয়ার অতীত ও বর্তমান

জামিয়ার অতীত ও বর্তমান

পৃথিবীর মানুষ যখন আল্লাহকে ভুলে পাপ পঙ্কিলতার ভারে বিপর্যস্ত। তখন ইলমে ওহীর আলো নিয়ে পবিত্র মক্কায় আবির্ভূত হন শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি মানুষকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনার জন্য ইলমে ওহীর প্রচার কেন্দ্র হিসাবে নির্বাচন করেন হযরত আরকাম (রা.) এর বাড়ী। ইসলামের ইতিহাসে বাড়িটি দারুল আরকাম নামে খ্যাত। এটি ইসলামী ইতিহাসে ইলমে ওহীর প্রথম মাদরাসা। মক্কার কাফেরদের অত্যাচারে বাধ্য হয়ে রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় হিজরত করেন। তিনি সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন, যা আজ মসজিদে নববী নামে প্রসিদ্ধ। দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্যে মসজিদকে কেন্দ্র করে চালু করেন দ্বীনি ইলমের দরসগাহ্। এভাবে চারশত বছর পর্যন্ত দ্বীনি শিক্ষার মারকায ছিল মসজিদ ভিত্তিক।

অতঃপর গজনীর সুলতান মাহমুদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘মাদ্রাসায়ে মাহমুদিয়া’। এরপর নিশাপুরের মাদ্রাসায়ে মাহমুদিয়া. বাগদাদের নিযামিয়া, মিশরের জামিয়া আযহার, তিউনেসিয়ার জামিয়া কাইরুয়ান, স্পেনের জামিয়া কার্ডোভা ও ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দসহ খ্যাতনামা দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলো মসজিদ কেন্দ্রীক উক্ত শিক্ষা ব্যবস্থারই বিস্তৃত রূপ।

যখন এদেশের মুসলমানদের হৃদয় থেকে ইসলামকে চিরতরে উৎখাত করার শক্ত প্রচেষ্টা চলছিল, তখন সেই বিদেশী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নিমিত্তে যে সকল মনীষী ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ইলমে দ্বীনের মশাল প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন, তাদের মধ্যে তৎকালীন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন হযরত মাওলানা ওবাইদুল হক সাহেব রহ. ছিলেন অন্যতম। তিনি দেওবন্দী চিন্তাধারা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশে ইসলামের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানাস্ত নিজগ্রাম নানুপুরের কালু মুন্সিরহাটে বর্তমান বাইতুল আমান জামে মসজিদের উত্তর পার্শ্বে মাদ্রাসায়ে হেমায়াতুল ইসলাম নামে দরসে নেজামীর সিলসিলাভুক্ত একটি মাদরাসা স্থাপন করেন এবং তিনি মাদরাসার  প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসাবে ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। মাদরাসা খুব দ্রুত উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। অল্প কিছু দিনের মধ্যে সত্যিকার জ্ঞান পিপাসু ত্বালিবে ইলমরা মাদ্রাসায় ভিড় জমায় এবং দ্বীনি ইলম অর্জন করতে থাকে। ছাত্ররা অত্র মাদরাসায় দরসে নেজামীর পাঠ্যক্রম অনুপাতে জামাতে চাহারুম পর্যন্ত শিক্ষালাভ করে ‘দারুল উলূম দেওবন্দ’ ও ‘দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী’ সহ অন্যান্য বড় জামিয়ায় গিয়ে অবশিষ্ট শিক্ষা সমাপ্ত করত।

এভাবে চলতে থাকে মাদ্রাসার শিক্ষাকার্যক্রম। তৎকালীন মাদ্রাসার অন্যান্য উস্তাযগণের মধ্যে ছিলেন, মাওলানা ওবাইদুল হক সাহেবের সুযোগ্য সন্তান হযরত মাওলানা জিয়াউল ইসলাম সাহেব রহ., হযরত মাও. মাহ্মূদুল ওলী সাহেব রহ.ও উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম দেওবন্দের ফাযিল ও পাকিস্তানের মুফতীয়ে আযম মাও. মুফতী শফী রহ.-এর বিশিষ্ট খলিফা মাইজভান্ডার নিবাসী হযরতুল আল্লাম মাও. আমীর উদ্দীন সাহেব রহ. প্রমুখ। তাঁরা সকলেই ছিলেন হযরত মাও. ওবাইদুল হক সাহেবের রুহানী সন্তান। ৮২ বৎসর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁরই সাহেবযাদা হযরত মাওলানা জিয়াউল ইসলাম সাহেব মাদরাসার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু অল্প কিছুদিন পরে তিনিও ইহজগত ছেড়ে চলে যান  মহান প্রভুর সান্নিধ্যে। তার ইন্তেকালের পর মাদরাসা ক্রমান্বয়ে অবনতির দিকে যেতে লাগল। তখন মাদ্রাসার পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তার ছোট ভাই হযরত মাওলানা মাজহারুল ইসলাম সাহেব রহ. একপর্যায়ে মাদ্রাসার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায় ।

প্রিয় উস্তাদের হাতে গড়া মাদ্রাসা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় নতুন করে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন তারই বিশেষ ছাত্র হযরত মাওলানা আমীর উদ্দীনসাহেব রহ.। হযরত মাও. মাহমূদুল ওলী সাহেব রহ. ও স্থানীয় সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ মাদ্রাসার ভিত্তি স্থাপনের জন্য একটি উপযুক্ত জায়গা খুঁজতে আরম্ভ করলেন। অনেক খোঁজাখুজি ও দীর্ঘ যাচাই বাছাইয়ের পর অবশেষে তৎকালীন সময়ের সেরা বুযুর্গ জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কুতবুদ দাওয়াহ্ ওয়াল ইরশাদ মাওলানা মুফতী আজিজুল হক সাহেব রহ. এর ইশারায় ও স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসলমান বিশেষ করে তৎকালীন অত্র অঞ্চলের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সমাজসেবক জনাব আলহাজ্ব মাস্টার মুহা. ফজলুর রহমান সাহেবের আপ্রাণ সহযোগিতায় বর্তমান জামিয়ার পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত ঘেরাও করা এবাদত খানার যে স্থানটি রয়েছে, সেখানে মাদ্রাসার কার্যক্রম আরম্ভ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
   

প্রিয় উস্তাদের নামানুসারে মাদ্রাসায়ে “ওবাইদিয়া হাফিজুল উলুম” নামকরণ করেন। মহান রাব্বুল আলামীনের উপর ভরসা করে ২৯ শে শাওয়াল ১৩৭৭ হিজরী মোতাবেক ১৯৫৭ সাল সোমবার মাদ্রাসায় লেখাপড়া আরম্ভ হয়। তখন ভ‚জপুরের ক্বারী হামেদ সাহেব রহ.ও তাদের সাথে ছিলেন। পরবর্তীতে জায়গার সংকুলান না হওয়ায় বর্তমান জামিয়ার মসজিদের স্থানে নির্মাণ করা হয় লম্বা একটি বাঁশের ঘর। এভাবে চলতে থাকে মাদ্রাসা।    
পরে তাদের সাথে যোগদান করেন মাও. আবু সুফিয়ান সাহেব রহ. ও মাওলানা জামাল উদ্দীন সাহেব রহ.। আর তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মাদ্রাসা উন্নতির দিকে পর্যায়ক্রমে এগিয়ে যেতে থাকে। অত্র মাদ্রাসার সূচনালগ্নে যেসব ব্যক্তিবর্গ বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন তাদের মধ্যে মরহুম ডা. আব্দুল মান্নান সাহেব,আলহাজ্ব আঃ সালাম সাহেব, জনাব শামসুল হুদা সওদাগর সাহেব, জনাব আলহাজ্ব আবুল কাশেম সওদাগর,  আলহাজ্ব বদিউল আলম সাওদাগর ও জনাব আলহাজ্ব মুয়াজ্জেম হোসেন সাওদাগর সাহেবের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের এই অবদান আজ স্মৃতির পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। 
   

তারপর ১৩৭৯ হিজরীর ৬ ই শাওয়াল মাদ্রাসার বার্ষিক সভায় পটিয়ার হযরত মুফতী সাহেব তাশরীফ আনেন । সেখানে তৎকালীন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় ধর্মপ্রাণ প্রভাবশালী মহলের অনুরোধের প্রেক্ষিতে হযরত মুফতী সাহেব রহ.-এর শ্রেষ্ঠ খলিফা হযরত মাওলানা সুলতান আহমদ নানুপুরীকে অত্র মাদ্রাসার অস্থায়ী মুহতামিম নিযুক্ত করেন। তখন তিনি বাবুনগর মাদ্রাসার বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ছিলেন। বাবুনগর মাদ্রাসায় যাওয়া আসার পথে এ মাদ্রাসায় উঠতেন এবং সুপরামর্শ দিতেন। অতঃপর ১৩৮০ হিজরী ১৫ই রমযান মুফতী সাহেব রহ.- এর ইন্তেকালের ১ সপ্তাহ পূর্বে তাকে নানুপুর মাদ্রাসার স্থায়ী মুহতামিম নিযুক্ত করেন। হযরত নানুপুরী রহ. অত্র মাদ্রাসায় আগমনের পূর্ব পর্যন্ত হযরত মাওলানা আমীর উদ্দীন রহ. অত্র মাদ্রাসার পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। এবং নানুপুরী রহ.-এর আগমনের পর তাকে সাদরে মহাপরিচালক হিসাবে গ্রহণ করে নেন। পরবর্তীতে যখন ১৩৯৩ হিজরীতে দাওরায়ে হাদীস সূচনা হয়, তখন থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি মুসলিম শরীফ ও তিরমিযী শরীফ দরস দানে রত ছিলেন। হযরত আল্লামা শাহ সুলতান আহমদ নানুপুরী সাহেব রহ. ৫ ই শাওয়াল ১৩৮০ হিজরীতে মুহতামিম হিসাবে নানুপুরে চলে আসেন। সে সময় মাদ্রাসার অবস্থা ছিল বড়ই নাজুক ও সংকটময়। শিক্ষাস্তর ছিল মাত্র জামাতে নাহুম পর্যন্ত। মকতবসহ গোটা মাদ্রাসায় ছাত্র ছিল ১০০/১৫০ জন । শিক্ষক ছিল ৫/৬ জন । তারা হলেন হযরত মাওলানা আমীর উদ্দীন সাহেব রহ., হযরত মাহমূদুল ওলী রহ., হযরত মাওলানা আবু সুফিয়ান রহ., হযরত মাওলানা সুলাইমান রহ., ও হযরত ক্বারী আফছার আহমদ দা.বা. প্রমুখ । বোডিং-এর অবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। কোনো কোনো সময় সামান্য ডাল-ভাত পাওয়া যেত আবার কখনও বা উপবাস থাকতে হত।    

তা-ছাড়া ছিলনা নিজস্ব কোনো মসজিদ, পুকুর, মাঠ ও দালান । হযরত নানুপুরী রহ. তখন বাড়ী থেকে হেঁটে মাদরাসায় আসতেন। এ কারণে তাকে প্রতিদিন হাটতে হত প্রায় আট দশ মাইল। হযরত কখনো সামান্য পান্তাভাত খেয়ে আসতেন। আবার কখনো উপবাসে কাটাতেন সারাদিন। কারণ আর্থিক অবস্থা ছিল নেহায়েত খারাপ। মাদ্রাসার ঘর দরজার কথাতো বলাই বাহুল্য। কেবল মাত্র ২০-২৫ হাত লম্বা একটি কুড়ে ঘর ছিল তাও আবার নড়বড়ে। উত্তর দক্ষিণের বাতাসে নিত্য হেলেদুলে কোনমতে নিজের অস্তিত্ব বহাল রাখতো । হঠাৎ একবার তুফান এলে সেটা একেবারে নষ্ট হয়ে যেত। মাদ্রাসার শিক্ষক এবং ছাত্ররা মিলে অতিকষ্টে সেই স্থানে বানালেন একটি মাটির ঘর। বর্ষাকালে পানি ঢুকলে সেটাও নষ্ট হয়ে যেত। বারংবার মেরামত করতে হত । এমনি করে অতিকষ্টে কেটেছে এই প্রতিষ্ঠানের শৈশব।
   

হযরত  নানুুপুরী হুজুর রহ.-এর ইখলাস, কর্মদক্ষতা ও অস্বাভাবিক রূহানী শক্তির বদৌলতে ধীরে ধীরে সেই ক্ষুদ্র ওবাইদিয়া হাফেজুল উলূম মাদ্রাসা আজকের আরব আজমসহ সমগ্র বিশ্বের পরিচিত একটি নাম জামিয়া ইসলামিয়া ওবাইদিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। হযরত নানুপুরী রহ. শারিরিক অসুস্থতার কারণে তার জীবদ্দশায় ইন্তেকালের ১০/১২ বছর পূর্বে ১৯৮৫ সালের দিকে তদীয় বিশিষ্ট খলিফা কালজয়ী সাধক খতীবে ইসলাম আল্লামা শাহ্ জমীরুদ্দীন রহ. কে সুযোগ্য মুহতামিম ও পরিচালক হিসাবে নিযুক্ত করেন। খতীবে ইসলাম আল্লামা শাহ্ জমীরুদ্দীন রহ. একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, আধ্যাত্মিক জগতের আলোকিত পুরুষ, হযরত নানুুপুরী রহ.-এর নিজ হাতে গড়া খাঁটি মানুষ ও হেদায়েতের পথ প্রদর্শক ছিলেন । হযরত নানুপুরী রহ. তাঁর মধ্যে অসাধারণ সাংঘঠনিক দক্ষতা, ইলমী যোগ্যতা এবং ঈমানী দৃৃঢ়তা দেখে তাকে এই বিশাল জামিয়ার পরিচালক নিযুক্ত করেন, তাঁর উপর দায়িত্বভার ন্যস্ত করে চিন্তামুক্ত হন । এবং ইন্তেকালের পূর্বে ১০/১২ বছর স্বচক্ষে তাঁর নিখুঁত পরিচালনা দেখে, অতঃপর ১৬ই আগষ্ট ১৯৯৭ইং শনিবার হযরত নানুপুরী হুজুর রহ. ইহকাল ত্যাগ করেন। 
   

তারপর থেকে হযরত শাহ জমীর উদ্দীন রহ. অত্যন্ত ত্যাগ তিতিক্ষা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সহিত অত্র জামিয়ার মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন  করেছেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও সুদক্ষ পরিচালনায় অত্র জামিয়া উন্নতির এক শীর্ষ চুড়ায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। চতুর্দিকে উঁচু উঁচু চুড়ার ন্যায় অট্টালিকাগুলোর বেষ্টনী, মধ্যখানে বিশাল মাঠ, সুউচ্চ তিনতলা বিশিষ্ট বিরাট মসজিদ, অত্যাধুনিক শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গেস্ট হাউস, চর্তুদিকে পাকাঘাট বিশিষ্ট পুকুর ও বিরল আকৃতির সুদর্শন বাবুর্চিখানা। সার্বক্ষণিক বিদুৎ ও জেনারেটর ব্যবস্থা। জামিয়ার এ বিশাল এলাকার প্রতিটি পয়েন্ট সর্বাধুনিক সি.সি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এক নিরাপদ পরিবেশ। সর্বদা হাজার হাজার তালিবে ইলমদের “ক্ব-লাল্লাহ”ও ‘‘ক্ব-লার রাসূল’’-এর গুঞ্জন। সর্বপোরি  স্নিগ্ধ-শীতল-মনোমুগ্ধকর এক বেহেশতী পরিবেশ । এ যেন মহান আল্লাহ তাআলার দেওয়া এক অপূর্ব নেয়ামত । যা সত্যিই দর্শক এবং পর্যটকদের মন জুড়ায় । 

বর্তমান ভৌগোলিক অবস্থান:
হাজারো ওলী-বুযুর্গ ও মহামনীষীদের কদম মোবারকের ধূলিতে ধন্য এ স্থানের মাটি। এমন মহান আদর্শবান ব্যক্তিদের পদাঘাতে যেন আবহমান কাল ধরে পাহাড় দেশ থেকে নেমে এসেছে অজস্র ঝর্ণার ফোয়ারা। চট্টগ্রাম শহরের ত্রিশ কি: মি: উত্তরের মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ফটিকছড়ি থানার অন্তর্গত যে গ্রাম নানুপুর,তারই বুকের পবিত্র ভূমিতে বিশাল এলাকা জুড়ে প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি শিক্ষার সুদূরপ্রসারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় “জামিয়া ইসলামিয়া ওবাইদিয়া”।  

বর্তমান জামিয়ার বহুমুখী শিক্ষার বিভিন্ন কার্যক্রম:
আল জামিয়া ইসলামিয়া ওবাইদিয়া উপমহাদেশের একটি প্রসিদ্ধ ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি আজ বিশ্বব্যাপী ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে ।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, আরব আমীরাত, কুয়েত, কাতার, মালোয়েশিয়া ও যুক্তরাষ্টসহ আরো বিভিন্ন দেশে এর ব্যাপক সুখ্যাতি রয়েছে। অত্র প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাপ্রাপ্ত ওলামা সমাজ উল্লেখিত প্রভৃতি দেশে ইসলামের ব্যাপক প্রচার -প্রসার ও বহুমুখী খিদমাত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন । অত্র প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক স্তর থেকে দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পর্যন্ত ইসলামী শিক্ষার পর হাদীস, ফিকাহ, তাজবীদ ও আরবী সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে।
   

এ প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ছাত্রদের দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কম্পিউটার, হস্তলিপি, টেইলারিং ও বই পুস্তক বাইন্ডিংসহ বিভিন্ন হস্তশিল্প ও কারিগরী  শিক্ষারও ব্যবস্তা রয়েছে।
এখানে অধ্যয়নরত ছাত্রদের বিনা বেতনে শিক্ষাদান এবং বাসস্থানের ব্যবস্থাসহ যাবতীয় পাঠ্য পুস্তক ফ্রি প্রদান করা হয় । বর্তমানে জামিয়ার ছাত্র সংখ্যা প্রায় ৮০০০ (আট হাজার ) এবং উস্তাদ ও অন্যান্য কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ১৫৫ (একশত পঞ্চান্ন) জন।

জামিয়ার শিক্ষা সংক্রান্ত স্তরসমূহ: 
(১) (ইবতিদাইয়্যাহ্) প্রাথমিক স্তর ৫ বছর। (২) (মুতাওয়াসসিতাহ্) মাধ্যমিক স্তর ৩ বছর । (৩) (সানুবিয়্যাহ্) উচ্চ মাধ্যমিক স্তর ৩ বছর । (৪) (ফযীলত)  স্নাতক স্তর ৩ বছর। (৫) (তাকমীল)  স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) স্তর ২ বছর।

তাখাচ্ছুছাত তথা উচ্চতর বিভাগসমূহ:
(১) তাখাচ্ছুছ ফী উলূমিত তাফসীর (উচ্চতর তাফসীর বিভাগ)
(২) তাখাচ্ছুছ ফী উলূমিল হাদীস (উচ্চতর হাদীস গবেষণা বিভাগ)
(৩) তাখাচ্ছুছ ফীল ফিক্বহিল ইসলামী ওয়াল ইফতা (উচ্চতর ইসলামী আইন বিভাগ) 
(৪) উচ্চতর তাজবীদ ও ক্বিরাত বিভাগ 
(৫) উচ্চতর আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ 
(৬) ক্বিসমুদ দা‘ওয়াহ ওয়াল ইরশাদ (উচ্চতর দাওয়া বিভাগ) 
(৭) উচ্চতর বাংলা/ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ

শিক্ষা সংক্রান্ত বিভাগসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ:
(১) ইসলামী কিন্ডার গার্ডেন বিভাগ: এ দেশে প্রচলিত ধর্মহীন কে.জি. স্কুলের বাস্তব প্রতিরোধ গড়ে তোলাই এ বিভাগ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য। এ বিভাগের শিশুদের আরবী, বাংলা ও ইংরেজী বর্ণমালার বিশুদ্ধ উচ্চারণ, অনুশীলন ও দেখে দেখে তাজবীদসহ কুরআন তিলাওয়াত, তাওহীদ ও প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা, নামায, আদ’ইয়ায়ে মাছূরা ও অন্যান্য ইবাদাতের বাস্তব প্রশিক্ষণ এবং ‘‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’’-এর সিলেবাসে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা, অংক ও ইংরেজী শিক্ষা দেওয়া হয় এবং কিতাব বিভাগের প্রথম জামাতে পড়ার প্রয়োজনীয় উর্দূ-ফার্সিও শিক্ষা দেওয়া হয়। এ বিভাগে শিক্ষা সমাপনকারী ছাত্ররা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারে । 
(২) তাহফীযুল কুরআন বিভাগ: এ বিভাগে মক্তব  সমাপনকারী ছাত্রদের সুদক্ষ হাফেয দ্বারা তিন বৎসরে সম্পূর্ণ কুরআন শরীফ তাজবীদ সহকারে মুখস্থ করানো হয়। 
(৩) মুতাফাররিকা (শর্ট কোর্স) বিভাগ: স্কুল- কলেজ ও ভার্সিটির যে সকল ছাত্ররা ইলমে দ্বীনের ফযীলত অনুধাবন করে আলিম হওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে জামিয়ায় ভর্তি হন, অনুরূপভাবে যারা পবিত্র কুরআনে কারীমের হিফজ সমাপন করে আসেন তাদেরকে এ বিভাগে মাত্র তিন বছরে জামাতে পাঞ্জুম পর্যন্ত দরসে নেজামীর সাত জামাত এর শিক্ষা দান করা হয় । অতঃপর তারা কিতাব  বিভাগে এসে নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন। 
(৪) কিতাব বিভাগ: এটা জামিয়ার পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থাপনা সমৃদ্ধ প্রধান বিভাগ।  এ বিভাগে মক্তব  বা হিফয শিক্ষা সমাপনকারী ছাত্রদেরকে ইসলামী শিক্ষাক্রমের ক্লাস পদ্ধতিতে মাত্র ১২ বৎসরে পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে কুরআন, হাদীস, ফিক্বাহ, তাফসীর, আকাইদ, আরবী সাহিত্য, নাহু, সরফ, অর্থনীতি, কাব্যরচনা, বালাগাত ফালসাফা, মানতিক ও হিকমত ইত্যাদি যাবতীয় ধর্মীয় বিষয়ে পূর্ণ পারদর্শী করে বিজ্ঞ আলেমরূপে গড়ে তোলা হয়। এবং তাদেরকে বিশ্বব্যাপী দ্বীনি খিদমাত আঞ্জাম দেওয়ার জন্য সনদ প্রদান করা হয় । সাথে সাথে এ বিভাগে তাদের প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা, অংক, ইংরেজি, ভূগোল ও বিজ্ঞান ইত্যাদির শিক্ষা দেয়া হয় ।

 

arrow_upward